London ০৩:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চা–বাগান যখন আমার ‘ক্লাসরুম’

শিক্ষার্থীর এই দল গিয়েছিল শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেটেছবি: সংগৃহীত

মাঠ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চা–শ্রমিকদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে একজন—ইমরান হাসান লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা।

চতুর্থ বর্ষের ফলিত নৃবিজ্ঞান কোর্সের অংশ হিসেবে তিন দিনের একটি সংক্ষিপ্ত মাঠ কার্যক্রমে আমরা গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেটে। ১৭-১৯ অক্টোবর সেখানে ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন বিভাগের চার শিক্ষক—অধ্যাপক আইনুন নাহার ও মাহমুদুল সুমন এবং সহকারী অধ্যাপক মোসাব্বের হোসেন ও আকলিমা আক্তার। একে তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ মাঠ কার্যক্রম, তার ওপর আবার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এর আগে কখনো চা–বাগানে যাননি। তাই সবার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল।

কাজের সুবিধার জন্য আমাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেওয়া হলো। একেক দলে সাতজন। প্রতিটি দল চা-বাগান এবং চা–শ্রমিকদের আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে কাজ করেছে।

মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেট বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো চা–বাগান, যার জন্ম ১৮৯৪ সালে। আয়তন প্রায় ১২৫০ একর। এক হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ১২টি চা-বাগানের একটি মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেট।

নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে চা–বাগানের ইতিহাস আমাদের অজানা না। তফাৎ হলো, এত দিন আমরা এই ইতিহাস বইয়ের পাতায়-পর্দায় চোখ রেখে জেনেছি আর এবার স্বচক্ষে, সশরীরে দেখার সুযোগ হলো।

চা–বাগান দেখতে যতটা সুন্দর, চা–শ্রমিকদের জীবন ততটাই করুণ, দুর্বিষহ এবং অমানবিক। দিনভর ২৩ কেজি পাতা তুলে ১৭৮ টাকা বেতন—এই অন্যায় মজুরি পৃথিবীর আর কোথাও দেওয়া হয় বলে আমার জানা নেই। সেটাও যদি ছয় সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকে, শ্রমিকদের বেঁচে থাকার উপায় কী হবে? প্রশ্নের উত্তর ভেবে পাইনি। চা–বাগানে ঢুকলেই দেখা যায়, প্রচুর মানুষের মল। এগুলো আসলে শ্রমিকদেরই ত্যাগ করা মল। কারণ, পুরো চা–বাগানে শ্রমিকদের জন্য কোনো টয়লেট নেই। টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লে চা–বাগানের কয়েক মাইল পথ পেরিয়ে যেতে হয় কলোনিতে। এর চেয়ে বাগানের কোনো আড়ালে মলত্যাগ করে ফেলাই সহজ।

চা–শ্রমিকদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অন্য রকম

চা–শ্রমিকদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অন্য রকমছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চা–পাতার ভর্তা নিয়ে ইদানীং বেশ ‘রোমান্টিকতা’ হয়। নিজের চোখে যখন দেখলাম, ঠিকমতো খেতে না পারা অস্থিসার মানুষ কোনো খাবারের সংস্থান করতে না পেরে বাধ্য হয়ে চায়ের পাতার ভর্তা করে ভাত বা রুটি দিয়ে খায়, তখন শহুরে মানুষের এই চা–পাতা ভর্তা নিয়ে আদিখ্যেতাকে মনে হয় নিষ্ঠুর মশকরা। এই সুযোগে জানিয়ে রাখি, মাধবপুর চা–বাগানের বেশির ভাগ শ্রমিকেরই মাতৃভাষা ভোজপুরি।

নানা অন্যায়, অবিচারের কথা জানার পরও শ্রমিকদের প্রতি সমব্যথী হওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না। মাঠ কার্যক্রম চলাকালে আমাদের অনেকে শ্রমিকদের সঙ্গে ছবি তোলেন, কেউ কেউ কথা বলতে বলতে চা–পাতা তোলায় সাহায্য করেন, কেউ আবার শ্রমিকদের সঙ্গে চা–পাতার ভর্তা খেয়েও দেখেন। এ সবই অভিজ্ঞতা হিসেবে আমাদের জন্য নতুন ছিল।

ফলিত নৃবিজ্ঞানে নৃবিজ্ঞানীদের কাজ হলো কোনো সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সেটার সমাধানের নীতি নির্ধারণী উপায় খোঁজা। ফলে, স্বভাবতই এই সংকটের সমাধান কী হতে পারে—সেই চিন্তা আমাদের মাথায় ঘুরছিল। আমার নিজের বোঝাপড়া থেকে মনে হয়, এই সমস্যার সমাধান করা কঠিন না। প্রশ্ন হলো রাষ্ট্র ও চা–বাগানের মালিক কর্তৃপক্ষ চায় কি না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বিস্তর গবেষণা। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে, চা–শ্রমিকদের সংকটের স্বরূপ বুঝতে এবং যথাযথ সমাধান পথ খুঁজতে গবেষণা খুব দরকার।

এসব ভাবতে ভাবতেই মাঠ কার্যক্রমের নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে আসে। এক অদ্ভুত বিষাদ আমাকে আর আমার সহপাঠীদের অনেককেই আক্রান্ত করে। ফিরতি পথে আমাদের চোখে ভাসতে থাকে কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ, হাড় জিরজিরে শরীর, হাত দিয়ে ডলে ভর্তা করতে থাকা চা–পাতা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০২:২৫:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪
৫১
Translate »

চা–বাগান যখন আমার ‘ক্লাসরুম’

আপডেট : ০২:২৫:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪

শিক্ষার্থীর এই দল গিয়েছিল শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেটেছবি: সংগৃহীত

মাঠ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চা–শ্রমিকদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে একজন—ইমরান হাসান লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা।

চতুর্থ বর্ষের ফলিত নৃবিজ্ঞান কোর্সের অংশ হিসেবে তিন দিনের একটি সংক্ষিপ্ত মাঠ কার্যক্রমে আমরা গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেটে। ১৭-১৯ অক্টোবর সেখানে ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন বিভাগের চার শিক্ষক—অধ্যাপক আইনুন নাহার ও মাহমুদুল সুমন এবং সহকারী অধ্যাপক মোসাব্বের হোসেন ও আকলিমা আক্তার। একে তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ মাঠ কার্যক্রম, তার ওপর আবার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এর আগে কখনো চা–বাগানে যাননি। তাই সবার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল।

কাজের সুবিধার জন্য আমাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেওয়া হলো। একেক দলে সাতজন। প্রতিটি দল চা-বাগান এবং চা–শ্রমিকদের আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে কাজ করেছে।

মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেট বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো চা–বাগান, যার জন্ম ১৮৯৪ সালে। আয়তন প্রায় ১২৫০ একর। এক হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ১২টি চা-বাগানের একটি মাধবপুর ন্যাশনাল টি এস্টেট।

নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে চা–বাগানের ইতিহাস আমাদের অজানা না। তফাৎ হলো, এত দিন আমরা এই ইতিহাস বইয়ের পাতায়-পর্দায় চোখ রেখে জেনেছি আর এবার স্বচক্ষে, সশরীরে দেখার সুযোগ হলো।

চা–বাগান দেখতে যতটা সুন্দর, চা–শ্রমিকদের জীবন ততটাই করুণ, দুর্বিষহ এবং অমানবিক। দিনভর ২৩ কেজি পাতা তুলে ১৭৮ টাকা বেতন—এই অন্যায় মজুরি পৃথিবীর আর কোথাও দেওয়া হয় বলে আমার জানা নেই। সেটাও যদি ছয় সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকে, শ্রমিকদের বেঁচে থাকার উপায় কী হবে? প্রশ্নের উত্তর ভেবে পাইনি। চা–বাগানে ঢুকলেই দেখা যায়, প্রচুর মানুষের মল। এগুলো আসলে শ্রমিকদেরই ত্যাগ করা মল। কারণ, পুরো চা–বাগানে শ্রমিকদের জন্য কোনো টয়লেট নেই। টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লে চা–বাগানের কয়েক মাইল পথ পেরিয়ে যেতে হয় কলোনিতে। এর চেয়ে বাগানের কোনো আড়ালে মলত্যাগ করে ফেলাই সহজ।

চা–শ্রমিকদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অন্য রকম

চা–শ্রমিকদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা অন্য রকমছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চা–পাতার ভর্তা নিয়ে ইদানীং বেশ ‘রোমান্টিকতা’ হয়। নিজের চোখে যখন দেখলাম, ঠিকমতো খেতে না পারা অস্থিসার মানুষ কোনো খাবারের সংস্থান করতে না পেরে বাধ্য হয়ে চায়ের পাতার ভর্তা করে ভাত বা রুটি দিয়ে খায়, তখন শহুরে মানুষের এই চা–পাতা ভর্তা নিয়ে আদিখ্যেতাকে মনে হয় নিষ্ঠুর মশকরা। এই সুযোগে জানিয়ে রাখি, মাধবপুর চা–বাগানের বেশির ভাগ শ্রমিকেরই মাতৃভাষা ভোজপুরি।

নানা অন্যায়, অবিচারের কথা জানার পরও শ্রমিকদের প্রতি সমব্যথী হওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না। মাঠ কার্যক্রম চলাকালে আমাদের অনেকে শ্রমিকদের সঙ্গে ছবি তোলেন, কেউ কেউ কথা বলতে বলতে চা–পাতা তোলায় সাহায্য করেন, কেউ আবার শ্রমিকদের সঙ্গে চা–পাতার ভর্তা খেয়েও দেখেন। এ সবই অভিজ্ঞতা হিসেবে আমাদের জন্য নতুন ছিল।

ফলিত নৃবিজ্ঞানে নৃবিজ্ঞানীদের কাজ হলো কোনো সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সেটার সমাধানের নীতি নির্ধারণী উপায় খোঁজা। ফলে, স্বভাবতই এই সংকটের সমাধান কী হতে পারে—সেই চিন্তা আমাদের মাথায় ঘুরছিল। আমার নিজের বোঝাপড়া থেকে মনে হয়, এই সমস্যার সমাধান করা কঠিন না। প্রশ্ন হলো রাষ্ট্র ও চা–বাগানের মালিক কর্তৃপক্ষ চায় কি না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বিস্তর গবেষণা। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে, চা–শ্রমিকদের সংকটের স্বরূপ বুঝতে এবং যথাযথ সমাধান পথ খুঁজতে গবেষণা খুব দরকার।

এসব ভাবতে ভাবতেই মাঠ কার্যক্রমের নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে আসে। এক অদ্ভুত বিষাদ আমাকে আর আমার সহপাঠীদের অনেককেই আক্রান্ত করে। ফিরতি পথে আমাদের চোখে ভাসতে থাকে কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ, হাড় জিরজিরে শরীর, হাত দিয়ে ডলে ভর্তা করতে থাকা চা–পাতা।