London ০২:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গল্প বলা যে কারণে অত্যন্ত জরুরি

অনলাইন ডেস্ক

পুকুরের পানির নিচের অলৌকিক জগত, মেছো ভুত, জলের ‘দেও’ আর জলপরীর গল্প শুনেছেন নিশ্চয়ই ছেলেবেলায়। শৈশবে দাদি-নানির কোলে বসে শোনা রাজা-রানীর গল্প, মায়ের মুখে শোনা রূপকথা, বাবার কাছে ঈশপের গল্প শোনার বায়না, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে করা ভূতের গল্প — এগুলো সবার জীবনের আনন্দময় স্মৃতি। মুখে মুখে প্রচলিত এসব গল্প আমাদের লোককথার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে, এগুলো আমাদের বেড়ে ওঠার অংশ।

গল্প বলার ঐতিহ্যকে উদযাপন করতে প্রতি বছরের আজকের দিনকে (২০ মার্চ) পালন করা হয় বিশ্ব গল্প বলা দিবস বা ওয়ার্ল্ড স্টোরিটেলিং ডে হিসেবে। দিসবটির সূচনা হয়েছিল সুইডেনে। ১৯৯১ সালে সুইডিশরা প্রথম ‘সকল গল্পকার দিবস’ (Alla Berättares Dag) পালন করেন। তাদের এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, এস্তোনিয়া, এবং লাতভিয়ার গল্পপ্রেমীরা একত্রিত হয়ে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়। তখন থেকেই মার্চের ২০ তারিখটি বিশ্বজুড়ে গল্প বলা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

প্রতি বছর এই দিনটির জন্য একটি বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়, যেমন, ভ্রমণ, প্রকৃতি, প্রেম ইত্যাদি। এ বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের বিশ্ব গল্প বলা দিবসের থিম বা বিষয়বস্তু হলো ‘গভীর জল’। এই থিমের অনেক অর্থ হতে পারে, যেমন এমন গল্প, যেখানে কোনো চরিত্র বিপদে পড়েছে, জাদুকরী জলের গল্প, কিংবা সমুদ্র, হ্রদ বা নদীর মতো গভীর জলের সঙ্গে যুক্ত গল্প।

কিন্তু গল্প বলা নিয়ে দিবস কেন? বিশ্ব গল্প বলা দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো গল্প বলার শিল্পকে উদযাপন করা এবং গল্পের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সংযোগ তৈরি করা। গল্প শুধু বিনোদন নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। গল্পের মাধ্যমে আমরা একে অপরের ভাবনা, অনুভূতি, এবং অভিজ্ঞতা বুঝতে পারি। এই দিনটিতে গল্প বলা এবং শোনার মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের সঙ্গে সংযুক্ত হই। এ কারণে গল্প বলাটা অত্যন্ত জরুরি।

 

বিশ্ব গল্প বলা দিবসে গল্প বলার নানা আয়োজন করা হয়। স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি, থিয়েটার, এমনকি পার্কেও গল্প বলার আসর বসে। গল্প বলার পাশাপাশি গান, নাচ, কবিতা, এবং নাটকের মাধ্যমে গল্পকে জীবন্ত করে তোলা হয়। গল্প শুধু মজা করার জন্য নয়, এটি আমাদের জীবনের অংশ। গল্পের মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রকাশ করি, অন্যকে বুঝি, এবং পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। গল্প আমাদের শিক্ষা দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়, এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, গল্প বলা এবং শোনা আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে, এবং মানসিক চাপ কমায়।

গল্প শুনলে আমরা নিজেকে সেই গল্পের চরিত্রের জায়গায় বসিয়ে ফেলি। আমরা হাসি, কাঁদি, ভয় পাই, এবং আশায় বুক বাঁধি। গল্পের মাধ্যমে আমরা নতুন জগতে প্রবেশ করি, যা আমাদের বাস্তব জীবনের চাপ থেকে মুক্তি দেয়। গল্প আমাদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে এবং নতুন ধারণা দেয়।

তবে সমাজের এগিয়ে চলার পথে গল্প বলার একটি শক্তিশালাী প্রভাব আছে। তাই এরিস্টটল বলেছেন- ‘যখন কোনও সমাজে গল্প বলার ধরণ খারাপ হয়ে যায়, তখন তার ফলাফল অবক্ষয়।’

বর্তমান ডিজিটাল যুগে গল্প বলার মাধ্যম বদলে গেছে। এখন গল্প শুধু মুখে মুখেই বলা হয় না, ব্লগ, পডকাস্ট, ইউটিউব, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও গল্প ছড়িয়ে পড়ে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো গল্পকারদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখন গল্প শোনার জন্য শুধু গল্প বলার আসরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরে বসেই আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গল্প শুনতে পারি।

বিশ্ব গল্প বলা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গল্প শুধু শব্দের সমষ্টি নয়, এটি আমাদের আবেগ, অনুভূতি, এবং স্বপ্নের প্রতিফলন। গল্পের মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছে পৌঁছাই ও নতুন সম্পর্ক তৈরি করি। তাই এই দিনে গল্পের জাদুতে মেতে উঠুন। গল্প বলুন, শুনুন, এবং গল্পের মাধ্যমে নিজের সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করুন।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ১১:০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
১৪
Translate »

গল্প বলা যে কারণে অত্যন্ত জরুরি

আপডেট : ১১:০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫

পুকুরের পানির নিচের অলৌকিক জগত, মেছো ভুত, জলের ‘দেও’ আর জলপরীর গল্প শুনেছেন নিশ্চয়ই ছেলেবেলায়। শৈশবে দাদি-নানির কোলে বসে শোনা রাজা-রানীর গল্প, মায়ের মুখে শোনা রূপকথা, বাবার কাছে ঈশপের গল্প শোনার বায়না, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে করা ভূতের গল্প — এগুলো সবার জীবনের আনন্দময় স্মৃতি। মুখে মুখে প্রচলিত এসব গল্প আমাদের লোককথার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে, এগুলো আমাদের বেড়ে ওঠার অংশ।

গল্প বলার ঐতিহ্যকে উদযাপন করতে প্রতি বছরের আজকের দিনকে (২০ মার্চ) পালন করা হয় বিশ্ব গল্প বলা দিবস বা ওয়ার্ল্ড স্টোরিটেলিং ডে হিসেবে। দিসবটির সূচনা হয়েছিল সুইডেনে। ১৯৯১ সালে সুইডিশরা প্রথম ‘সকল গল্পকার দিবস’ (Alla Berättares Dag) পালন করেন। তাদের এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, এস্তোনিয়া, এবং লাতভিয়ার গল্পপ্রেমীরা একত্রিত হয়ে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়। তখন থেকেই মার্চের ২০ তারিখটি বিশ্বজুড়ে গল্প বলা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

প্রতি বছর এই দিনটির জন্য একটি বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়, যেমন, ভ্রমণ, প্রকৃতি, প্রেম ইত্যাদি। এ বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের বিশ্ব গল্প বলা দিবসের থিম বা বিষয়বস্তু হলো ‘গভীর জল’। এই থিমের অনেক অর্থ হতে পারে, যেমন এমন গল্প, যেখানে কোনো চরিত্র বিপদে পড়েছে, জাদুকরী জলের গল্প, কিংবা সমুদ্র, হ্রদ বা নদীর মতো গভীর জলের সঙ্গে যুক্ত গল্প।

কিন্তু গল্প বলা নিয়ে দিবস কেন? বিশ্ব গল্প বলা দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো গল্প বলার শিল্পকে উদযাপন করা এবং গল্পের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সংযোগ তৈরি করা। গল্প শুধু বিনোদন নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। গল্পের মাধ্যমে আমরা একে অপরের ভাবনা, অনুভূতি, এবং অভিজ্ঞতা বুঝতে পারি। এই দিনটিতে গল্প বলা এবং শোনার মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের সঙ্গে সংযুক্ত হই। এ কারণে গল্প বলাটা অত্যন্ত জরুরি।

 

বিশ্ব গল্প বলা দিবসে গল্প বলার নানা আয়োজন করা হয়। স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি, থিয়েটার, এমনকি পার্কেও গল্প বলার আসর বসে। গল্প বলার পাশাপাশি গান, নাচ, কবিতা, এবং নাটকের মাধ্যমে গল্পকে জীবন্ত করে তোলা হয়। গল্প শুধু মজা করার জন্য নয়, এটি আমাদের জীবনের অংশ। গল্পের মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রকাশ করি, অন্যকে বুঝি, এবং পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। গল্প আমাদের শিক্ষা দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়, এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, গল্প বলা এবং শোনা আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে, এবং মানসিক চাপ কমায়।

গল্প শুনলে আমরা নিজেকে সেই গল্পের চরিত্রের জায়গায় বসিয়ে ফেলি। আমরা হাসি, কাঁদি, ভয় পাই, এবং আশায় বুক বাঁধি। গল্পের মাধ্যমে আমরা নতুন জগতে প্রবেশ করি, যা আমাদের বাস্তব জীবনের চাপ থেকে মুক্তি দেয়। গল্প আমাদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে এবং নতুন ধারণা দেয়।

তবে সমাজের এগিয়ে চলার পথে গল্প বলার একটি শক্তিশালাী প্রভাব আছে। তাই এরিস্টটল বলেছেন- ‘যখন কোনও সমাজে গল্প বলার ধরণ খারাপ হয়ে যায়, তখন তার ফলাফল অবক্ষয়।’

বর্তমান ডিজিটাল যুগে গল্প বলার মাধ্যম বদলে গেছে। এখন গল্প শুধু মুখে মুখেই বলা হয় না, ব্লগ, পডকাস্ট, ইউটিউব, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও গল্প ছড়িয়ে পড়ে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো গল্পকারদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখন গল্প শোনার জন্য শুধু গল্প বলার আসরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরে বসেই আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গল্প শুনতে পারি।

বিশ্ব গল্প বলা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গল্প শুধু শব্দের সমষ্টি নয়, এটি আমাদের আবেগ, অনুভূতি, এবং স্বপ্নের প্রতিফলন। গল্পের মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছে পৌঁছাই ও নতুন সম্পর্ক তৈরি করি। তাই এই দিনে গল্পের জাদুতে মেতে উঠুন। গল্প বলুন, শুনুন, এবং গল্পের মাধ্যমে নিজের সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করুন।